
ঢাকা: মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যাকাণ্ডে জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে একমাত্র আসামি করে মামলা করা হয়।
আদালতে তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম বলেন, ‘তিন্নির লাশের ছবি যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয়, সেদিন সকালে কলাবাগানে অভির সঙ্গে আমার ভাইয়ের দেখা হয়। অভি বলেছে- তিন্নিকে খুঁজতে হবে না।’ আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে একমাত্র আসামি করে মামলাটি করা হয়।
দীর্ঘদিন পর মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলায় বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম ও বড় চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
৫ জানুয়ারি বুধবার ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে মাহবুব করিমের সাক্ষ্য শেষ হলেও রেজাউল করিমের জবানবন্দি এখনও শেষ হয়নি। তিনি আজ আদালতে আংশিক সাক্ষ্য দেন।
আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য পরবর্তী তারিখ ঠিক করেছেন বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ভোলা নাথ দত্ত।
১৯ বছর আগের আলোচিত হত্যা মামলাটির রায় ঘোষণার কথা ছিল গত ১৫ নভেম্বর। তবে তিন্নির বাবা ও চাচা সাক্ষ্য দেয়ার আবেদন জানানোয় ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কেশব রায় চৌধুরী রায় ঘোষণা স্থগিত করে তিন্নির বাবা ও চাচার সাক্ষ্য নিতে ৫ জানুয়ারি তারিখ দেন।
কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদীর ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর অজ্ঞাতপরিচয় নারীর মরদেহ পায় পুলিশ। পরদিন পত্রিকায় ছবি প্রকাশ হলে সেটি মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নির বলে শনাক্ত করেন তার এক আত্মীয়।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে একমাত্র আসামি করে মামলাটি করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ভোলা নাথ দত্ত বলেন, তিন্নির বাবা ও চাচার আংশিক সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছিল। তারা তাদের সাক্ষ্য পুনরায় গ্রহণের জন্য আবেদন করেছেন। আদালত সেই আবেদন গ্রহণ করেছে।
কী বললেন তিন্নির বাবা-চাচা
জবানবন্দিতে তিন্নির বাবা মাহবুব করিম বলেন, ‘তিন্নি আমাকে ৫ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে টেলিফোনে বলে ধানমন্ডি যাওয়ার জন্য। আমি সেখানে যাই। তিন্নি আমাকে বাবু নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তিন্নি তখন অলরেডি জানত যে ওই বাবুই অভি। আমাকে তিন্নি এটাও বলে যে বাবু ভাই হচ্ছেন অভি। আমাকে অনেক সম্মান করল। জুস খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন।
পরে আমি তিন্নিকে নিয়ে বাসায় চলে আসি।’ আসার সময় আমি তিন্নিকে জিজ্ঞাসা করি, অভির সঙ্গে এই ঘোরাঘুরি কেন করছ? তিন্নি বলে- অভির সঙ্গে তার অ্যাফেয়ার। অভি তাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছে।
তখন আমি তিন্নিকে তার স্বামী পিয়ালের কথা বলি। তাকে বলি, এখন তুমি কীভাবে অভিকে বিয়ে করবে? আমি বলি, এমন বিয়ে আমরা মানি না। তিন্নি বলে, আমি পিয়ালের সঙ্গে থাকতে চেয়েছি কিন্তু সে আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। পরের দিন রাত ১০টায় অভি আমাকে তিন্নি-পিয়ালের বাসায় ডেকে নিয়ে যায়।
সেখানে পিয়াল ছিল। পিয়ালের ভাই রিয়াল এবং কাজের দুই মেয়েও ছিল। অভি আমাকে বলে, পিয়ালের কাছ থেকে সে তালাক নিয়ে নেবে। তারপর অভি পিয়ালকে ধমকের সুরে বলে, সে ২টা ডিভোর্স লেটার ব্যাকডেটেট পাঠাবে। সেগুলো পিয়াল ব্যাকডেট দিয়ে সিগনেচার করে নেবে।
অভি পিয়ালকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই বাসার মধ্যে তোমার কী কী জিনিস আছে? পিয়াল বলে এই বাসায় যা আছে সবই তার। তারপর অভি বলে -রোজার ঈদের পরেই সে তিন্নিকে বিয়ে করবে। তখন রোজা চলতেছিল। অভি বলে মেয়ে আনুষ্কা পিয়ালের কাছে থাকবে। তারপর অভি অদ্ভুত ধরনের চেহারা করে তিন্নিকে চার্জ করে বলে- সে কতজনের সঙ্গে রাত যাপন করেছে। এটা তাকে খুলে বলতে। তিন্নি আমার সামনে সব স্বীকার করে।
তারপর অভি তিন্নিকে বলে তার ব্যাংকে কত টাকা আছে? তিন্নি বলে -৭০ হাজার টাকা আছে। মাঝে পিয়াল বলে- এক লাখ ৪০ হাজার টাকা ছিল। তখন অভি তিন্নিকে বলে সে কেন মিথ্যা বলল?
একপর্যায়ে পিয়াল অভিকে বলে, অভি ভাই আপনাকে নাকি তিন্নির বাবা দেখে নেবে। আসলে এতদিন আমি পিয়ালকে বলেছিলাম যে তিন্নিকে তুমি সাপোর্ট করো বলে বলেছিলাম এবং আমি অভির বিষয়টা দেখতে বলেছিলাম। অভি সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পিস্তল বের করে আমার মাথার ডান পাশে তাক করে বলে- ওই শালার বেটা, তোর সাহস আছে আমাকে দেখে নিবি? আমি তখন ভয়ে বলি, অভি ভাই আমি তো আপনারে চিনি নাই।
তখন অভি বলে- এখন বুঝছোস তো আমি কে? এরপর অভি পিস্তল নামায়। তারপর আমাকে বলে- এই বাসায় আর আসবি না। আরও বলে সে তিন্নিকে নিয়ে হজ করতে যাবে। আমি তখন বলি-তুমি কোন আইনে বিয়ে ছাড়া তিন্নিকে নিয়ে ওমরাহ করতে যাবে? পরে আমাকে চলে যেতে বললে, আমি রাত ১২টার দিকে আমার নিজের বাসায় চলে আসি। এদিন সম্ভবত ৬ নভেম্বর ছিল।
মাহবুব করিম বলেন, ‘৭/৮ তারিখ আমি আর তিন্নি কেউ কারও বাসায় যাইনি বা দেখা হয়নি। দুইজনই আমরা লজ্জা পাচ্ছিলাম। ১০ তারিখ সন্ধ্যার পর আনুমানিক ৭টা বা সাড়ে ৭টার সময় আমার বাসায় আসে। সেখানে আমার বাবা-মাও থাকত। তিন্নিকে কিছু খেতে দেয়া হয়।
ও বলে সে রোজা রেখেছে। তিন্নি ৫-৭ মিনিট, বেশি হলে ১০ মিনিট ওই বাসায় ছিল। দাদাকে সে পা ধরে সালাম করে। বুকে জড়িয়ে আদর করে। আমাকে সরি বলে। বলে যে, ওই দিনের জন্য দুঃখিত। তাকে মাফ করে দিতে বলে। তারপর ছাদে গিয়ে আমার মা যেখানে মারা গিয়েছিল, সেখানে গিয়ে সালাম করে।
তিন্নি দাদা, দাদির কাছেই বড় হয়েছিল। এরপর আমি তিন্নিকে থাকতে বলি। তিন্নি বলে অভি এসে নাকি ফাংশনে নিয়ে যাবে। তিন্নি বলে- তাকে যেতে হবে। তারপর তিন্নি চলে যায়। বাসার কাজের ছেলে মহসিন তিন্নিকে নামিয়ে দেয়। তখন আটটা বাজে হয়তো।’
তিনি বলেন, ‘৯টার সময় তিন্নির বাসার কাজের মেয়ে বীনা আমার বাসায় এসে জিজ্ঞাসা করে তিন্নি আপু কোথায়? আমি বলি, ও তো চলে গেছে আরও আগে। বীনা বলে, অভি ভাই আইসা তিন্নিকে না পাইয়া রাগারাগি করতেছে।
রাত ১০টা পর্যন্ত বীনা ২/৩ বার আসে তিন্নিকে খুঁজতে। আমরাও অস্থির হয়ে যাই। খুঁজতে শুরু করি। রাত ১১টার দিকে আব্বা বড় ভাইকে বলে- তোরা রাতে বাসায় থাকিস না, অভি এসে শাসিয়ে গেছে। আব্বা আমাদের কোথাও চলে যেতে বলে। ভাইয়া তখন আমাকে রামপুরার এক আত্মীয়র বাসায় নিয়ে যায়। পরের দিন আমাকে ওখানে রেখে ভাইয়া কলাবাগানের বাসায় চলে আসেন।
১৫ তারিখ পর্যন্ত আমি ওখানেই ছিলাম। ১৫ তারিখ সকাল ৯/১০ টার সময় মামাতো ভাই পেপারে তিন্নির লাশের ছবি দেখে আমাকে দেখায়। আমি লাশ দেখে চিনতে পারি। তারপর আমরা কেরানীগঞ্জ থানায় যাই। আমি লাশ দেখতে চাই। তার পরদিন পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশ তোলা হয় জুরাইন কবরস্থান থেকে।
আমরাও সেখানে ছিলাম। লাশ চিনতে পারি। পরে আমরা পত্রিকায় এবং মানুষের মুখে শুনতে পারি যে অভিই তিন্নিকে হত্যা করেছে। তিন্নির লাশের ছবি যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয়, সেদিন সকালে কলাবাগানে অভির সঙ্গে আমার ভাইয়ের দেখা হয়। অভি বলেছে- তিন্নিকে খুঁজতে হবে না। অভি ভাইয়াকে ৫০০ টাকা দিয়েছিল। কিন্তু ভাইয়া নেয়নি।
এরপর তিন্নির বড় চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম জবানবন্দি দেয়া শুরু করেন। কিন্তু তা শেষ হয়নি।