
গবেষণা বলছে, ওজন কমানো এবং রক্তে সুগার বা শর্করা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখার ক্ষেত্রে কিটো ডায়েটের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। কেটোজেনিক ডায়েট মেনে চললে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের শরীরে গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণে থাকে। রক্তে ভালো মানের কোলেস্টেরল নিশ্চিত করা এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতেও এই ডায়েট বিশেষ কার্যকর।
কিটোজেনিক ডায়েটে একজন মানুষ তার খাদ্যতালিকা থেকে কার্বোহাইড্রেট যতটা সম্ভব এড়িয়ে ছেঁটে ফেলেন। কিন্তু শরীরের জ্বালানির জোগান তো ঠিক রাখতে হবে। তাই জ্বালানির চাহিদা মেটাতে কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে ফ্যাট বা চর্বি বেছে নেন তিনি। প্রচলিত অর্থে, চর্বি খাওয়া মানে হলো ওজন কমানো।
কিটোর সুবিধা শুধু ওজন কমানোতে আটকে নেই। এটি মৃগী রোগীদের খিঁচুনি এড়াতেও সাহায্য করে। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতেও কিটো ডায়েটকে উপযোগী মনে করা হয়।
আজকের দিনটি তাদের জন্য, যারা কিটো ডায়েট করেন। তিন বছর ধরে ৫ জানুয়ারি পালিত হচ্ছে কিটো দিবস। যারা এই ডায়েট করার চিন্তাভাবনা করছেন তারা কিটো লাইফস্টাইল শুরু করতে আজকের দিনটিকে বেছে নিতে পারেন।
আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, কিটোজেনিক বা কিটো ডায়েট হলো বিশেষ খাদ্যব্যবস্থা, যেখানে শর্করার পরিমাণ কম ও চর্বির পরিমাণ বেশি। সাধারণ খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ থাকে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ। কিটো ডায়েটে তা কমে দাঁড়ায় ৫ থেকে ১০ ভাগ।
সাধারণ খাদ্যতালিকায় চর্বির পরিমাণ থাকে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। কিটোতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ শতাংশ। তবে আমিষ বা প্রোটিনের পরিমাণ সাধারণ তালিকার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
তবে যারা কিটো শুরু করতে চান তাদের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকাটা জরুরি, যা ‘কিটো ফ্লু’ নামে পরিচিত। কিটোজেনিক ডায়েট শুরুর ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে কিটো ফ্লু’র উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণত মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা, ক্লান্তি, বিরক্তি, বমি বমি ভাব, ঘুমাতে অসুবিধা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।
বলা হয়, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ডায়েট শুরু করাটা বোকামি। কারণ চিকিৎসকরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সার্বিক স্বাস্থ্যের বিষয় জেনেবুঝেই তার খাদ্যতালিকা তৈরি করে দেন।
অবশ্য অনলাইনে কিটো ডায়েট নিয়ে নির্ভরযোগ্য পরামর্শের অভাব নেই। কিম কারদাশিয়ান এবং হ্যালি বেরির মতো জনপ্রিয় হলিউড সেলিব্রিটিরাও এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
আধুনিক স্বাস্থ্য কৌশল হিসেবে কিটোজেনিক ডায়েটের উদ্ভব ১৯২০ সালের দিকে। মূলত শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক মৃগী রোগীদের চিকিৎসা হিসেবে এটি ব্যবহার হতো। পরে খিঁচুনির কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার হলে কিটো ডায়েটের প্রভাব কিছুটা কমে আসে।
হাল সময়ে এসে ১৯৯৪ সালে বদলে যায় দৃশ্যপট। হলিউড প্রযোজক জিম অ্যাব্রাহামসের সন্তান কিটো ডায়েট করে মৃগীরোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। আর তাতেই কিটোজেনিক থেরাপির জন্য চার্লি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাব্রাহামস।
হলিউডের কিংবদন্তি অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপকে নিয়ে একটি টিভি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন অ্যাব্রাহামস। কিটো ডায়েটের গুণগান সংবাদমাধ্যমেও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এরপরই চার্লি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয় কেটোজেনিক্সের অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা। এর মধ্য দিয়ে তা শুধু আমেরিকা নয়, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশ্ন আসতেই পারে, ২০ শতকের চিকিৎসকরা কীভাবে জানলেন কার্বোহাইড্রেট কমানো গেলে মৃগী রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?
প্রকৃত ইতিহাস লুকিয়ে আছে প্রাচীন গ্রিসে। ‘হিপ্পোক্রেটিক কর্পাস’-এ ওই সময়ের চিকিৎসকরা লিখেছিলেন- সাধারণ মানুষ যেভাবেই দেখুক, মৃগী রোগ অতিপ্রাকৃত কিছু নয়। তাদের মতে এটি একটি জৈবিক রোগ, যা কঠোর উপবাসে নিরাময় হয়।
বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা ও গবেষণায় স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে স্টার্চ ও চিনিমুক্ত খাদ্য কঠোর উপবাস থেকে মুক্তি দিতে পারে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এর বিকল্প হিসেবে তারা দাঁড় করান কিটো ডায়েট।
মস্তিষ্কের কার্যপরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি আলঝেইমার, পারকিনসন্স, অনিদ্রাসহ নানা কিছুতে কিটো ডায়েটকে বেশ উপযোগী হিসেবে দেখছেন চিকিৎসকরা।
২০০৭ সাল পর্যন্ত কিটো ডায়েট চর্চা ৪৫টি দেশে সীমাবদ্ধ থাকলেও, এখন তা পৌঁছে গেছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জনপদে।
গবেষণা বলছে, ওজন কমানো এবং রক্তে সুগার বা শর্করা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখার ক্ষেত্রে কিটো ডায়েটের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। কেটোজেনিক ডায়েট মেনে চললে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের শরীরে গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণে থাকে। রক্তে ভালো মানের কোলেস্টেরল নিশ্চিত করা এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতেও এই ডায়েট বিশেষ কার্যকর।
কিটো ডায়েটকে আরও জনপ্রিয় করতে ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে কিটো দিবস পালন শুরু করে ‘ভিটামিন শপ’। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কিটোজেনিক ডায়েটের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা এবং এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যের ভালো দিকগুলো তুলে ধরে কিটো লাইফস্টাইলে মানুষকে আগ্রহী করে তোলা।