
ঢাকা: হতাহতের ঘটনার দায় নিতে নারাজ নির্বাচন কমিশন। সহিংসতা ও মৃত্যুর দায় প্রার্থীদের বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। তবে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বলছে, দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৭ জনের প্রাণহানির তথ্য মিলেছে। গত জুন থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ ধাপের নির্বাচনের প্রতি ধাপেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সংঘাতে মৃত্যু হয়েছে।
পঞ্চম ধাপের ভোট শেষে বৃহস্পতিবার বেলা ২টা পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। এর আগে চতুর্থ ধাপে তিনজন, তৃতীয় ধাপে অন্তত ১০ জন, দ্বিতীয় ধাপের আগে পরে ১৬ জন ও প্রথম ধাপে সাতজনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।
এসব সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরে মারাও গেছেন। তবে হতাহতের ঘটনার দায় নিতে নারাজ নির্বাচন কমিশন।
পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেছেন, চলমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভোটে সহিংসতা ও মৃত্যুর দায় প্রার্থীদের।
এ ধাপে ভোট চলাকালে ও পরে মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, শরীয়তপুর, জামালপুর ও চাঁদপুরে সহিংসতায় ১১ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে গাইবান্ধায় ভোটকেন্দ্রের বাইরে একজনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এর পরও নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও আনন্দমুখর বলে দাবি করেন ইসি সচিব।
ইউপি নির্বাচনে রক্ত ঝরছেই, পাঁচ ধাপে প্রাণহানি ৪৭
তিনি বুধবার বিকেলে বলেন, ‘আজকে নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ছয়জন মারা গেছেন। এটা অবশ্যই দুঃখজনক, তবে ওই ছয় কেন্দ্র ছাড়া অন্য জায়গায় নির্বাচনে তেমন সমস্যা হয়নি। তাই এখন পর্যন্ত যে নির্বাচন হয়েছে, সেটিকে আমরা বলব ভালো নির্বাচন। সামনে নির্বাচন আরও ভালো হবে।’
তবে ইসির এই বক্তব্যের বিপরীত মেরুতে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা যেভাবে চলছে, তাতে দেশের রাজনীতি ও দলগুলো হুমকির মুখে পড়বে।’
বনানীতে রাজনৈতিক কার্যালয়ে গাজীপুর মহানগর নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘নির্বাচনব্যবস্থা এভাবে চলতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো হারিয়ে যাবে। নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন খুবই অসহায়। তাদের যে ফলাফল ধরিয়ে দেয়া হয়, নির্বাচন কমিশন তা-ই ঘোষণা করছে।
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নির্বাচনে এই সহিংসতার ঘটনায় সরকারকে আক্রমণ করে আসছে। দলটির দাবি, সরকার নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন পেশিশক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোট।
ইউপি নির্বাচনে রক্ত ঝরছেই, পাঁচ ধাপে প্রাণহানি ৪৭
পঞ্চম ধাপে বুধবার ভোট হয়েছে দেশের ৭০৮টি ইউপিতে। ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টার পর থেকেই বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আসতে থাকে সংঘর্ষ-সহিংসতার খবর।
চাঁদপুরের কচুয়া ও হাইমচরের দুই কেন্দ্রে সংঘর্ষে বিকালে দুজনের প্রাণহানির খবর জানান পুলিশ সুপার (এসপি) মিলন মাহমুদ। তবে সন্ধ্যায় এসপি কার্যালয় থেকে জানানো হয়, কচুয়ায় যিনি নিহত হয়েছেন বলে তখন জানা গিয়েছিল, তিনি হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন।
এসপি জানান, হাইমচরের নীলকমল ইউনিয়নে একটি কেন্দ্রে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত অজ্ঞাতপরিচয় যুবক বহিরাগত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গাইবান্ধার সাঘাটায় যাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে তার নাম আবু তাহের। মেম্বার প্রার্থী আইজল মিয়ার সমর্থক ছিলেন তিনি। আইজলের প্রতিদ্বন্দ্বী রাসেল আহমেদের সমর্থকরা তার ওপর হামলা করে বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বি সার্কেল) ইলিয়াস জিকো।
ইউপি নির্বাচনে রক্ত ঝরছেই, পাঁচ ধাপে প্রাণহানি ৪৭
গাইবান্ধার সাঘাটায় যাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে তার নাম আবু তাহের
বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় ভোট চলাকালে ও ভোট গণনাকালে দুই কেন্দ্রে সহিংসতায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন।
এর মধ্যে দুপুরে ভোট চলাকালে গাবতলীর রামেশ্বরপুর জাইগুনি গ্রামের একটি কেন্দ্রে দুই ইউপি সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে জাকির হোসেন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
আর বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের কালাইহাটার একটি কেন্দ্রে সন্ধ্যায় ভোট গণনার সময় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চারজন।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের বাচামারা ইউনিয়নের বাচামারা ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে ছলেমন খাতুনের মৃত্যু হয়। মরদেহ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানোর কথা জানিয়েছেন শিবালয় সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার তানিয়া সুলতানা।
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একটি কেন্দ্রে মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকের হামলায় অংকর দত্ত নামে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী টিউবওয়েল প্রতীকের সমর্থক বলে জানা গেছে।
জামালপুরে বকশীগঞ্জের মেরুরচর ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রে নৌকা ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন আলামিন নামে এক যুবক। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোয়ার হোসেনের কর্মী বলে জানা গেছে। এই ইউপিতে নৌকার প্রার্থী ছিদ্দিকুর রহমান।
এর আগে ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপের ভোট হয়। এ ধাপের ভোট চলাকালে কেউ মারা না গেলেও ভোট গণনা-পরবর্তী সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঠাকুরগাঁও, পটুয়াখালী ও সিলেটে নিহত হন তিনজন।
এ ছাড়া কিছু স্থানে ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, সংঘর্ষ এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ইউপি নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে সহিংসতায় একজন বিজিবি সদস্যসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন। এ ধাপে আহত হন দেড় শতাধিক মানুষ। গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ, জাল ভোট, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ নানা অনিয়মের ঘটনাও ঘটে।
ইউপি নির্বাচনে রক্ত ঝরছেই, পাঁচ ধাপে প্রাণহানি ৪৭
এর আগের ধাপগুলোর মধ্যে বেশি প্রাণহানি ঘটে দ্বিতীয় ধাপে। প্রাইমনিউজের হিসাবে এই ধাপের ভোটের আগে-পরে অন্তত ১৬ জন নিহত হন। এর মধ্যে শুধু নরসিংদীতেই মৃত্যু হয়েছে সাতজনের।
এত প্রাণহানির জন্য ইউপি নির্বাচনে দল থেকে প্রার্থী দেয়ার বিষয়টিকে সামনে এনেছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রথা তুলে না দিলে সন্ত্রাস-সংঘাত আরও বাড়বে।
নিজ কার্যালয়ে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস ও সংঘাত যেন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এখন ভোটযুদ্ধে যুদ্ধ আছে, ভোট নেই। কিন্তু নির্বাচন ও সন্ত্রাস একসঙ্গে চলতে পারে না।
ইউপি নির্বাচনে সন্ত্রাসের কারণ জেনে তা থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার হয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন ইসি মাহবুব তালুকদার।