আগামী জাতীয় নির্বাচনের কৌশল সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ

Friday, January 14th, 2022

মনিরুল ইসলাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট :  দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এর অংশ হিসেবে প্রথমেই দলের বিতর্কিতদের ছেঁটে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দলকে অধিক সক্রিয় করে তুলতে পরিবর্তন আসছে সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে। একই সঙ্গে দলের ত্যাগী ও সুবিধাবঞ্চিতদের সামনে আনার কথা ভাবা হচ্ছে।

গুঞ্জন আছে মন্ত্রিসভা থেকে বিতর্কিতদের বাদ দেয়ারও। বিতর্কিত আমলাদেরও গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আসন্ন জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও বার্তা থাকছে।

সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক সূত্র, সিনিয়র মন্ত্রী, দায়িত্বশীল সিনিয়র আমলা ও আওয়ামী লীগ নেতা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার তালিকায় রয়েছেন কমপক্ষে চারজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী। মন্ত্রিত্ব হারানোর পাশাপাশি তারা দলীয় পদ থেকেও বাদ পড়তে পারেন।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব বিষয়ে দ্রুতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। ইতিমধ্যে তিনি কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিবকে মন্ত্রিসভা ও একনেক বৈঠকে সতর্ক করেছেন। তাতেও সংবিত না ফেরায় তারা বাদ পড়ছেন দায়িত্বশীল পদ থেকে।

সূত্র মতে, বাদ পড়াদের তালিকায় রয়েছেন কমপক্ষে চারজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী। মন্ত্রিত্ব হারানোর পাশাপাশি তারা দলীয় পদ থেকেও বাদ পড়তে পারেন।

মন্ত্রিসভায় রদবদলের গুঞ্জন
নির্বাচনি কৌশল সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ
প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানো মুরাদ হাসান।

সম্প্রতি মন্ত্রিসভা থেকে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ বাদ পড়ার পর নতুন করে মন্ত্রিসভায় রদবদলের গুঞ্জন শুরু হয়।

বর্তমান মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি। ইতিমধ্যে তিন বছর পার করেছে এই মন্ত্রিসভা। এরপর থেকে এতে খুব বড় ধরনের রদবদল আসেনি। এক দফায় কেবল কয়েকজন মন্ত্রীর দপ্তর পরিবর্তন হয়েছিল। সেই রদবদলে অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিমকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।

দ্বিতীয় দফায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর মৃত্যুর পর ওই মন্ত্রণালয়ে নতুন প্রতিমন্ত্রী দেয়া হয়েছিল। আর শেষ পর্যায়ে মন্ত্রিসভায় ড. শামসুল আলমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে।

বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন সময় মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদলের কথা আলোচনায় এলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীদেরকে সুযোগ দিয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছেন।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মুরাদের ঘটনার পর যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে তাতে মন্ত্রিসভার রদবদল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যে নির্বাচনি অঙ্গীকার তা পূরণের তাগিদ অনুভব করছে সরকার। অনেক মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা বিরাজ করছে। অনেক মন্ত্রী রুটিন কাজও ঠিকমতো করতে পারছেন না। সবাই তাকিয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর দিকে।

সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন!

নির্বাচন সামনে রেখে দল গোছানোর প্রক্রিয়ায় সাধারণ সম্পাদক পদেও পরিবর্তন আসার খবর ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ওই দায়িত্ব কে পাচ্ছেন তা নিয়েও চলছে আলোচনা।

২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর অষ্টমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেবার সভাপতি পদে শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করেছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। সমর্থন করেন সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য মোশাররফ হোসেন। পরে কাউন্সিলররা তা গ্রহণ করেন।

সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করেন বিগত কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তা সমর্থন করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর গঠিত কমিটিতেও দলের শীর্ষ দুই পদে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

তবে এবার সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন দেখছেন দল ও সরকারের অনেকেই। এ জন্য বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের শারীরিক অসুস্থতাকে বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অন্যান্য পদেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ হিসেবে করোনা মহামারিতে অনেক দায়িত্বশীল নেতা ও সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে পদ শূন্য হওয়া এবং অভিজ্ঞদের মধ্যে বয়সজনিত নিয়মিত অসুস্থতাকে কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন তারা।

অন্যদিকে দলে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে বড় বড় পদে থাকা বেশকিছু নেতাকে সরিয়ে ত্যাগী ও সুবিধাবঞ্চিতদের সামনে আনার কথা বলছেন অনেকে। আওয়ামী লীগ সভাপতিরও তেমনটাই ইচ্ছা বলে জানাচ্ছে দলীয় সূত্র।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘সুশাসন নিশ্চিত করতে দুর্নীতিবিরোধী যে সংগ্রাম করছি আমরা তা বাস্তবায়নের পথে আছি। দুর্নীতি-সংশ্লিষ্ট কেউ যেন আমাদের দলে ঢুকতে না পারেন এবং যারা ঢুকে পড়েছেন তাদের বের করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।

রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আমরা এটা করছি। যারা বিতর্কিত, অজনপ্রিয়, মাদক-সম্রাট ও মাদকসেবী, যারা জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, আইন ও দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, যারা সাম্প্রদায়িক তাদেরও আমরা দল থেকে বের করে দেয়ার কাজ শুরু করেছি।

তৃণমূলে সুশাসনের নির্দেশনা আসছে
নির্বাচনি কৌশল সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ
সম্মেলনে বিভিন্ন জেলার প্রশাসকরা।

ঢাকায় আগামী ১৮ জানুয়ারি শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ আড়াই বছর পর এই সম্মেলন হচ্ছে। এবারের সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের ওপর তৃণমূলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কঠোর নির্দেশনা আসতে যাচ্ছে।

সচিবালয় সূত্র জানায়, ডিসি সম্মেলনের যাবতীয় নথিপত্র ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের প্রতি সর্বত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর মনোভাব প্রদর্শনের নির্দেশনা থাকছে।

সম্মেলনে চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জনেও দিকনির্দেশনা থাকবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সরকার-সংশ্লিষ্টরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভালো। আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। তবে এটা যেন কেবল কথার কথা না হয়। কেবল যেন স্লোগানে আবদ্ধ না থাকে।

‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স- স্লোগানটা বাস্তবায়নে সুশাসন অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানবাধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। মানুষের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি কার্যক্রমে মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে।’

কারা নেতৃত্ব দেবেন নির্বাচনি মাঠে
নির্বাচনি কৌশল সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ
প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম।

প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এইচ টি ইমামকে বলা হতো আওয়ামী লীগের নির্বাচনি কৌশল নির্ধারণের প্রাণভোমরা। প্রচলিত আছে, নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসন সাজানো থেকে শুরু করে জয়ের কৌশল ঠিক করতেন তিনি। সাবেক এই আমলার মৃত্যু দলের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করেছে বলে মনে করেন অনেকে।

তবে একাধিক সূত্র জানায়, আগামীতে এইচ টি ইমামের ভূমিকায় দেখা যেতে পারে তূলনামূলক কম আলোচিত একজনকে। তিনি দায়িত্ব সামলাবেন একটি টিম হিসেবে। ফলে নির্বাচনের মাঠে কৌশল নির্ধারণ ও জয় বের আনতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলটির দায়িত্বশীলরা।

সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এবার গভর্নমেন্ট নয়, গভর্নেন্সকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনি কৌশল ঠিক করছে সরকার। ফলে কে এতে লিড দেবে সেটা বড় কিছু নয়। হয়তো ছোটখাটো অবয়বের কেউই নেতৃত্ব দেবেন। তবে ফলটা খারাপ হবে না।

‘ইতিমধ্যে প্রশাসন ও সচিবালয় গোছানোর কাজ শুরু হয়েছে। বিতর্কিত, কর্তৃত্ববাদী, আত্মপ্রচারমুখী ও স্বার্থপর শ্রেণির কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন দায়িত্বে আনা হবে।’

বিদেশি শক্তির প্রভাব বলয় ভেঙে নির্বাচন

নির্বাচন সামনে রেখে সরকার যে কাজ শুরু করছে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় নতুন বছর ও বর্তমান মেয়াদের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বিক উন্নয়নে টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা উল্লেখ করে আরো সমর্থন প্রত্যাশা করেন।

তবে আগামী নির্বাচন অতটা সহজ হবে না বলে মনে করে সংশ্লিষ্ট একটি মহল। তারা এ ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তির প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। সম্প্রতি পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞাকে এর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন তারা।

সরকারও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাবলিক ডিপ্লোমেসি উইং ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে ফোনালাপ এরই অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন তুলে ধরার নির্দেশনাও একটি কৌশল বলে মনে করছেন অনেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ অবশ্য এ বিষয়ে পুরোপুরি একমত নন। তিনি বলেন, ‘র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধকে নির্বাচনি চাপ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না।

কারণ ওরা বলুক আর না-ই বলুক, আমরা নিজেরাই তো জানি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়। এতে আমেরিকা কী বলল, তাতে কী আসে যায়! তাদের বলায় সব হলে তো এতদিনে অনেক কিছুই হতো; বা বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জন্ম হতো না।’

ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি বা নির্বাচনে আমাদেরকে সবার আগে দেশের জনগণের ওপরই নির্ভর করা উচিত। আর জনগণ বলতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন বাহিনী, সংগঠন, দল-উপদল যা আছে, তারাই নির্বাচন সম্পর্কে ভালো জানে। এই স্টেক হোল্ডাররাই ঠিক করবে নির্বাচন কেমন হবে। কারা ক্ষমতায় আসবে।

‘এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা দুর্বল। একটি দেশের বয়স ৫০, রাতারাতি এখানে নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে না। আমরা কিন্তু ভারত বা আমেরিকায়ও খারাপ নির্বাচন দেখি। আমাদের এখানে যত পরিবর্তন এসেছে, তা জনগণের হাতেই হয়েছে।

শুনতে হয়তো ভালো লাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, কিন্তু এ দেশের সব পরিবর্তন কিন্তু এসেছে জনগণের হাত ধরে। এখানে কিন্তু ওয়াশিংটন বা দিল্লি কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।