‘রেম্বা’ দ্বীপ: যৌনকর্মী ও মাদকের স্বর্গরাজ্য

Friday, March 24th, 2023

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম এবং পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম হ্রদ ভিক্টোরিয়া। কেনিয়া, তানজানিয়া এবং উগান্ডার মধ্যবর্তী একটি সুউচ্চ মালভূমির উপর রয়েছে এই লেক। দৈর্ঘে হ্রদটি ৩৫৯ কিলোমিটার, প্রস্থে ৩৩৭ কিলোমিটার। আয়তনে হ্রদটি প্রায় ৫৯ হাজার ৯৪৭ বর্গ কিলোমিটার। লেক ভিক্টোরিয়ার নীল পানিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার দ্বীপ। এগুলোর অনেক দ্বীপেই আছে জনবসতি। হ্রদের পানিতে মাছ ধরেই জীবন চালান হাজার হাজার যাযাবর মৎস্যজীবী। যাদের নিজস্ব বাড়ি-ঘর নেই।

এই লেকে পাওয়া যায় বিখ্যাত নাইল-পার্চ মাছ। ইউরোপে এই মাছের বিশাল চাহিদা রয়েছে। লেক ভিক্টোরিয়ার ঘন নীল পানিতে হাজারো দ্বীপে লুকিয়ে আছে কেনিয়ার আওতায় থাকা এক কুখ্যাত ও বিতর্কিত দ্বীপ ‘রেম্বা’। যৌনকর্মী, আফ্রিকার কুখ্যাত অপরাধী, মাদক পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য এই দ্বীপ।

মাত্র ২০০০ বর্গ মিটারের এই দ্বীপের জনসংখ্যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ১৩১ জন। বর্তমান জনসংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। দ্বীপের পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রা লেক ভিক্টোরিয়ায় মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। বাকি ৪০ শতাংশ এই দ্বীপে অন্য ব্যবসা করেন। ক্ষুদ্র দ্বীপটি যেন খুদে আফ্রিকা। আফ্রিকার সব দেশের মানুষদের এখানে পাওয়া যাবে। তবে জনসংখ্যার ২০% হচ্ছে কেনিয়ার, বাকিরা এসেছেন এবং আসেন দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, তানজানিয়া, উগান্ডা ও অন্যান্য দেশে থেকে।

চারদিকে নীল জলরাশির মাঝে একটি দ্বীপের যেমন সৌন্দর্যের কথা মনে আসে, এই দ্বীপে তার কিছুই নেই। ছোট্ট দ্বীপটিতে পা ফেলার জায়গা নেই, গিজগিজ করছে মানুষ। গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে করোগেটেড টিনের চালাঘর। রেম্বাতে স্বাস্থ্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা কেউ ভাবেন না।

দ্বীপের চারদিকে থিকথিক করছে আবর্জনা। মলমূত্র, ব্যবহৃত স্যানিটারি প্যাড থেকে কন্ডোম, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ও সুই। এই পরিবেশে বাস করছেন ২০ হাজার মানুষ। দ্বীপের চারদিকে লেকের পানিতে ভাসছে আবর্জনা। কাক চিলেরা সেগুলি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। সেই নোংরা পানিতেই চলছে গোসল করা থেকে রান্নাবান্না। চতুর্দিকে শুঁটকি মাছ ও ফেলে দেওয়া পচা মাছের গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে দেশি মদের গন্ধ।

রেম্বা দ্বীপের টিনের ছাউনি দেওয়া বাড়িগুলো, প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় দু’বার ভাড়া দেওয়া হয়। ঘরগুলো দিনে একজন ও রাত্রে আর একজন ভাড়া নেন। যারা রাতে মাছ ধরেন তারা দিনের জন্য ঘর ভাড়া নেন। কেউ দিনে মাছ ধরলে,ঘর ভাড়া নেন রাতটুকুর জন্যই। ভাড়া ৮০০ থেকে ৩৬০০ টাকা। এই বাড়িগুলোকে বলে ‘উসিসেমে‘। কিছু ‘উসিসেমে’ বাড়ি যৌনকর্মীরা ভাড়া নিয়ে রাখেন। তাদের ব্যবসা চালানোর জন্য। প্রতিদিন ভোরে রেম্বা দ্বীপ থেকে ২০০ জন লোক চলে যান এবং প্রতিদিন এই দ্বীপে ৪৯০ জন নতুন লোক ঢোকেন।

২০ হাজার মানুষের জন্য দ্বীপে আছে মাত্র চারটি পাবলিক টয়লেট। টয়লেট বলতে মাটির ভেতরে করা গর্ত, চার দিকে আড়াল, এইটুকুই। বেশিরভাগ মানুষ লেকের তীরেই বসে যান। দূষণ ও আবর্জনায় দ্বীপের পরিবেশ এখন পুরোপুরি নরক। দ্বীপে ওষুধের দোকান আছে। কিন্তু যিনি দোকানদার তিনিই ডাক্তার। চিকিৎসকরা হাতুড়ে। ভুল ওষুধে শিশুর মৃত্যু নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বেশির ভাগ ওষুধের দোকান নেশার ট্যাবলেট, অন্যান্য ড্রাগ ও কন্ডোম বিক্রি করে। চিকিৎসার অভাবে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও বয়স্কদের মধ্যে যৌনরোগ দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে দ্রুত ছড়াচ্ছে এইডস।

এই দ্বীপে জেলে নৌকা ভাড়া দেওয়া হয়। যদিও জেলে নৌকার মালিকদের বেশিরভাগই এই দ্বীপে বাস করেন না। বেশিরভাগ বোট মালিক রেম্বা দ্বীপে তাদের এজেন্ট রেখে দিয়েছেন। এজেন্টদের কাছ থেকে যন্ত্রচালিত নৌকা ভাড়া নিয়ে পানিতে নামেন মৎস্যজীবীরা। অনেক সময় এজেন্টরা জেলে ভাড়া করে পানিতে নৌকা নামান। বেশিরভাগ জেলেই ১২-৩৫ বছরের স্কুলছুট তরুণ। প্রতিদিন ৫০ লাখ টাকার মাছ ব্যবসা হয় রেম্বা দ্বীপে।

লাভের ৭০-৮০ শতাংশ মুনাফা পান বোট মালিক, বাকি ২০-৩০ শতাংশ পান জেলেরা। এই বোট মালিকরাই দ্বীপের অন্যান্য ব্যবসাগুলো চালান অর্থাৎ দোকান, সেলুন, হোটেল থেকে বার, এমনকি পতিতাপল্লীও। এই ২০০০ বর্গমিটার দ্বীপের মধ্যে আছে, মাছের আড়ত, জুয়ার অসংখ্য কাউন্টার, মদ ও ড্রাগের পাব, সেলুন, ওষুধের দোকান, খাবার হোটেল ও হাজার তিনেক যৌনকর্মী।

লোকে এখানে যেমন আমির হয়, তেমনি ফকিরও হয়। এখানে দেহব্যবসা বেআইনি নয়। সারাদিন লেকের চারদিক থেকে এসে ভিড়ছে মাছ ভর্তি জেলে নৌকা। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ধরা মাছ রেম্বা দ্বীপের আড়তে বেচেন মৎস্যজীবী্রা। মাছ বেচা টাকা দিয়ে পতিতা সঙ্গে করে বা সেই টাকা ড্রাগ ও মদে উড়িয়ে পরদিন আবার নৌকা নিয়ে পানিতে নামেন হাজার হাজার মৎস্যজীবী।

আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে রেম্বাতে এসে ওঠেন যৌনকর্মীরা। কেউ সন্তান নিয়ে আসেন, কারও এখানে এসে সন্তান হয়। বয়স হয়ে গেলে বা যৌনরোগ ধরা পড়ে গেলে দ্বীপ ছাড়তে হয়।একজন যৌনকর্মী দিনে ৩০০০ থেকে ৬০০০ টাকা আয় করেন। দ্বীপে ব্যাংক নেই, তাই যৌনকর্মীরা টাকা রাখতে বাধ্য হন নিজের পোশাকের মধ্যে। কখনও সেই টাকা খরিদ্দার কেড়ে নেন, তো কখনও দ্বীপের দাদারা। তাই কয়েক সপ্তাহ পরপরই টাকাকড়ি নিয়ে উধাও হয়ে যান বেশ কিছু যৌনকর্মী।

চলে যাওয়া যৌনকর্মীর জায়গায় আমদানি হয় নতুন যৌনকর্মীর। রেম্বা দ্বীপের সারি সারি টিনের চালাঘরে বিভিন্ন বয়সের যৌনকর্মীদের ভিড়। জায়গা নেই তাই একই ঘরে দশ বারো জন যৌনকর্মী একই সঙ্গে খদ্দের সামলান।

রেম্বাতে দ্বীপে আছেন মাত্র ৯ জন পুলিশ, এদের পক্ষে ২০ হাজার মানুষকে সামলানো অসম্ভব। একদল বিচ্ছিন্ন ও অপরাধপ্রবণ মাসাই হলো এই অদ্ভুত দ্বীপের সেনবাহিনী। দ্বীপের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা কেনিয়ার মাসাইদের অর্থ দিয়ে পোষেন। পরিবর্তে মাসাইরা আদিম ব্যবসাকে সুরক্ষা দেয়। নৌকা ভাসিয়ে তারা পাক খায় দ্বীপের চারদিকে। অপরাধ করে আইনের হাত এড়িয়ে রেম্বাতে লুকিয়ে থাকা ও রেম্বা থেকে পানিপথে পার্শ্ববর্তী যেকোনও দেশে পালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত সহজ। তাই দুর্বল আইন ও দুর্বল প্রশাসনের ছাতার তলায় দ্বীপ রেম্বা হয়ে উঠেছে যৌনকর্মী ও অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য।

সূত্র: দ্য ওয়াল