
ঢাকা: বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের সাথে তাদের ৫০ বছরের সম্পর্ক উদযাপন করছে বেশ আয়োজন করে। এই উদযাপনে অংশ নিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন।
বিশ্ব ব্যাংকের যে শাখা- ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ)- নিম্ন আয়ের দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য ঋণ দেয়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দেশ বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশেরও সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক।
বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে, সত্তরের দশকের শুরুতে উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের সক্ষমতা সম্পর্কে ব্যাংক যতটুকু ধারণা করেছিল, সেটিকে বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।
গত ৫০ বছরে আইডিএ-এর কাছ থেকে অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ আর কম সুদে প্রায় তিন হাজার ৯০০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ।
গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের নিম্ন আয়ের ৭৪টি দেশে কার্যক্রম ছিল আইডিএ-এর। বিশ্বব্যাংকের এই সংস্থাটির লক্ষ্য হলো আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা দিয়ে একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মানুষের জীবনমান উন্নত করা।
বাংলাদেশ শুরুর দিকে আইডিএ-এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী না থাকলেও গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে এই অবস্থান অর্জন করেছে বলে বলেন বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে সহযোগী দেশগুলোকে কী পরিমাণ ঋণ দেয়া হবে, তা আইডিএ-এর একটা তিন বছরের চক্রে নির্ধারিত হয়। প্রতি তিন বছর পর এটি নবায়ন হয়। ২০১৫-১৬ সালের আগে বাংলাদেশ তাদের জন্য বরাদ্দ ঋণ ব্যবহার করতে পারত না।’
সেসময় বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণের যে অংশ অব্যবহৃত থাকত, তা অন্যান্য দেশকে দিয়ে দেয়া হতো।
তবে ২০১৫-১৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশ আইডিএ-এর তিন বছরের চক্রে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণের পুরো অংশ ব্যবহার করার পর আফ্রিকান কয়েকটি দেশের জন্য বরাদ্দ হওয়া অব্যবহৃত ঋণও ব্যবহার করেছে বলে জানান জাহিদ হোসেন।
এছাড়া বরাদ্দ হওয়া ঋণ সময়মতো ছাড় না হওয়ার কারণেও কাগজে-কলমে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সুবিধাভোগী দেশের তালিকার শীর্ষে।
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মনে করুন আইডিএ আপনাকে কোনো প্রকল্পে পাঁচ বছরের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিলো। কিন্ত কোনো কারণে ওই সময়ের মধ্যে আপনি পুরো টাকাটা ছাড় করাতে পারলেন না। তখন বাকি টাকাটা পাইপলাইনে থেকে যায়। এর মধ্যে তিন বছর পর আবার আইডিএ নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন ওই টাকাটাও সেখানে জমে আর পাইপলাইন ফুলতে থাকে।’
২০১৬ সালের পর থেকে ‘অর্থায়ন যোগ্য প্রকল্প’ আইডিএ-এর কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছে বলেই বাংলাদেশের পাওয়া ঋণের বরাদ্দ বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন হোসেন।
অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, ১৫-২০ বছর আগেও বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণের সাথে বিভিন্ন শর্ত বা উন্নয়নের মডেল ‘চাপিয়ে দেয়া’ দিত বলে মনে করত বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি অন্যরকম।
‘আমরা অনেক সময় টাকা পাওয়ার জন্য দ্রুততার সাথে অনেক শর্ত মানি। কিন্তু সেসব শর্তের সাথে যেসব অঙ্গীকার করি, তা আর মানি না ‘
পদ্মা সেতু ইস্যুতে ‘শীতল সম্পর্ক’
অর্থনীতিবিদদের মতে, গত ৫০ বছরে একবারই বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের ‘শীতল সম্পর্ক’ তৈরি হয়েছিল। সেটি হলো ২০১২ সালে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে।
সেসময় বিশ্ব ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প (১২০ কোটি ডলার) ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প। সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এবং সেই তদন্তে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় এই পদক্ষেপ নিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। তবে পরে এসব অভিযোগের কোনোটিই প্রমাণিত হয়নি।
ওই সময় ‘ছয় থেকে ১২ মাসের জন্য’ বাংলাদেশের সাথে বিশ্ব ব্যাংকের একটি শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল বলে মনে করেন সংস্থাটির বাংলাদেশ অফিসের সাবেক লিড ইকনমিস্ট জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু থেকে সরে আসার পরে বিশ্ব ব্যাংক তাদের কান্ট্রি অ্যাসিস্ট্যান্ট স্ট্র্যাটেজি রিভিউ করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে বাংলাদেশে ভৌত অবকাঠামোগত হাই রিস্ক প্রকল্পে তারা ভেবেচিন্তে ঋণ দেবে। কিন্তু পরে বিশ্বব্যাংকের ভেতর থেকেই একটা আপত্তি আসে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ভৌত অবকাঠামো তৈরিতে সহায়তা না করলে উন্নয়নে অবদান কিভাবে রাখা যাবে!’
তবে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে আসার পর বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে বলেন জাহিদ হোসেন।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বাজারে তাদের সাফল্য দেখাতে হয়। তারাও বিশ্বের বাজার থেকেই টাকা তোলে। উন্নয়ন সাফল্যের হিসেবে ৮০-৯০’এর দশকের বড় বড় ঘাটতি আছে তাদের। সেজন্য বাংলাদেশকে তুলনামূলকভাবে সাফল্যের একটি গ্রহণযোগ্য বা নমুনা দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে আসার পর তারা আরো নমনীয় হয়েছে।’
বাংলাদেশে আলোচিত ছিল যেসব প্রকল্প
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সবচেয়ে বড় অবাকাঠামো প্রকল্প ছিল বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু বা যমুনা সেতু।
এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সংস্থাটির সহায়তায় নির্মাণ হয় পল্লী সড়ক। শিক্ষা, জ্বালানি, দুর্যোগ মোকাবেলায়ও বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক। তবে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কিছু প্রকল্প নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে।
আশির দশকের শেষভাগে বাংলাদেশে বন্যা প্রতিরোধ করার জন্য ‘ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান’ নামে একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চেয়েছিল সংস্থাটি। ওই প্রকল্পের অধীনে দেশের তিনটি প্রধান নদীর পারে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
বিশ্ব ব্যাংক নিয়ে যেসব অভিযোগ ওঠে
বিশ্ব ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা একটি দেশের সরকার, তার অঙ্গ সংগঠন ও সহযোগী সংগঠনের সাথে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
কোনো একটি প্রকল্পে অর্থায়ন ও সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা মূলত সরকারের ওপরই নির্ভরশীল থাকে। এ কারণে অনেক সময় তাদের প্রকল্পের ‘প্রকৃত সুবিধাভোগী’দের বক্তব্যটা উঠে আসে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, ‘যে মানুষগুলোর জন্য টাকাটা আনা হয়, তাদের কণ্ঠটা না থাকার কারণে তারা সুবিধাটা পেয়েছে কি পায়নি, ওই মূল্যায়নটা সঠিকভাবে হয় না। অথচ এই মানুষগুলোই করের টাকা দিয়ে পরে এই ঋণ শোধ করবে। একটি দেশের ভেতরে যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতার জায়গাটা যদি দুর্বল থাকে, তাহলে এই সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর প্রায় অনুপস্থিত হয়ে যায়।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে হাতে নেয়া উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন উদাহরণ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের কাজের পরিধির বিচারে সেগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলা যায় বলে মন্তব্য করেন জাহিদ হোসেন। তবে তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাংক এই ধরণের অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত করার বিষয়ে জোর দিয়ে থাকে। বিশ্বব্যাংকের কোনো প্রকল্পের কারণে যদি আপনার ক্ষতি হয়, তাহলে আপনি বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি বিভাগের কাছে আপনার অভিযোগ জানাতে পারবেন। তখন ব্যাংকের একটি দল গিয়ে সম্পূর্ণ নিজেদের মত করে অভিযোগের তদন্ত পরিচালনা করে ‘
সূত্র : বিবিসি