
ছিলেন গ্রাম্য পশু চিকিৎসক। অর্থাভাবে এক বেলা হাঁড়ি চড়ে তো আরেক বেলা উপোস। সেই মানুষটিই চার থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে শত কোটি টাকার মালিক। গ্রামের বাড়িতে উঠেছে পাকা ভবন। ঢাকার গুলশান-বনানীতে একাধিক ফ্ল্যাট, কক্সবাজারে হোটেল ভবন, দামী গাড়ি- সে এক এলাহী কাণ্ড!
মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা নাসির কাজী নামের সম্পদহীন মানুষটি কোন আলাদিনের চেরাগের সন্ধান পেয়ে এভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলেন- এমন প্রশ্ন আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিতমণ্ডলের সর্বত্র।
সরেজমিনে ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে নেপথ্য কারণটা অবশেষে জানা গেছে। নাসিরের এই আলাদিনের চেরাগ আর কিছু না, দালালি। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে অন্যের জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক দেখিয়ে টাকার কুমির হয়েছেন এই দালাল।
নাসিরের এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষ। মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে দালাল নাসির চক্র মানুষকে ঠকিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল টাকা।
পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন কাজে অনিয়মের অভিযোগে নাসির কাজীর নাম শীর্ষে রেখে ২০ দালালের তালিকা করেছে জেলা প্রশাসন। তালিকাটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর পর তা তদন্তাধীন।
ইতোমধ্যে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দুই কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত চলছে তহশিলদার ও আরও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবে চক্রের হোতা নাসির কাজীসহ দালালরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

যেভাবে নাসিরের দুর্নীতি
নাসির কাজীর নেতৃত্বে একটি চক্র পদ্মা সেতুর রেললাইন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে ভিপি ও খাস সম্পত্তি থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তার এক সময়ের সহযোগীদের বক্তব্য থেকে এমন তথ্য জানা যায়। তারা জানান, অধিগ্রহণের জন্য নির্বাচিত জমির ভুয়া নথি ও নকল মালিক সাজিয়ে বিল তুলে নেয় চক্রটি। যে নারী বা পুরুষকে নকল মালিক সাজানো হয় তাকে পরে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়া হয়।
নাসিরের লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ২ লাখ টাকা ভাগ পেয়ে জেল খাটেন দত্তপাড়ার ইউপি সদস্য শুধাংশু মণ্ডল। জেলে রয়েছেন নাসিরের আরেক সহযোগী শাহীন বেপারি।
নাসির কাজীর টোপে পড়ে জমির ভুয়া মালিক সেজে স্বাক্ষর দেন আলো পত্তনদার। বিনিময়ে তাকে দুই লাখ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয় ৪৫ হাজার টাকা। তার মতো আরও অনেকেই নাসির চক্রের পাতা ফাঁদে লোভের বশে পা দিয়ে এখন প্রশাসনিক তদন্তের মুখে পড়েছেন।
মুকুলী রানী নামে এক নারীকে নাসির চক্র দুই দফায় দুটি বিলে ৪ লাখ টাকা দিয়েছে। দুর্নীতির তদন্ত শুরু হওয়ার পর ওই টাকা ফেরত দেয়ার নোটিশ আসার পর থেকে তিনি বাড়িছাড়া।
ভুয়া বিল ছাড়া অন্যের টাকাও তুলে নেন নাসির কাজীসহ দালাল চক্র এবং জেলা প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
শিবচরের মাদবরচরের ডাইয়ার চর মৌজায় পদ্মা সেতুর রেল লাইন প্রকল্পের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে হারুন বেপারি, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার বেগম ও ছেলে মেহেরাব হোসেন পার্শ্ববর্তী দোকানঘর ও জমির জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৪ ধারা, ৭ ধারা ও ৮ ধারায় নোটিশ পান। তবে ওই নোটিশ পাওয়াই সার। ডিসি অফিসে বার বার ঘুরেও বিল পাচ্ছেন না তারা।
দীর্ঘ চেষ্টার পর ক্ষতিগ্রস্তরা জানতে পারেন যে ওই দাগগুলোর বিপরীতে অধিগ্রহণ বাবদ এক কোটি ৮৮ লাখ টাকা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে তুলে নিয়ে গেছেন নাসির কাজীর নেতৃত্বে দালালরা। আসামিদের কেউ ওই এলাকার বাসিন্দা না হওয়া সত্ত্বেও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহায়তায় এই দফায় প্রায় ২ কোটি টাকা লোপাট হয়।
জালিয়াতির এই ঘটনায় শাহীন বেপারি নামে এক দালালকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি মামলায় আসামি হয় জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত শীর্ষ দালাল নাসির কাজী, তার দুই মামা ও আরেক নিকট আত্মীয়।
গ্রেপ্তার হওয়া শাহীনের পরিবার আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। শাহীনের নামে প্রায় ২ কোটি টাকার বিল ছাড় হলেও লোপাট করা টাকা থেকে মাত্র ২০ লাখ টাকা ভাগ পায় তারা। বাকি টাকা নেয় নাসিরসহ দালাল চক্রের অন্যান্য সদস্য ও ডিসি অফিসের লোকজন।
ভুক্তভোগী হারুন বেপারি বলেন, ‘আমাদের সব কাগজপত্র আছে। কিন্তু শাহিন বেপারি ও নাসির কাজীসহ চারজন ভুয়া কাগজপত্র অফিসে দাখিল করে আমাদের ক্ষতিপূরণের এক কোটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার তিনশ’ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পরে জানতে পেরেছি জাল কাগজপত্র তৈরি করে ওরা টাকা উত্তোলন করেছে। আর এর সঙ্গে ডিসি অফিসের কর্মকর্তারাও জড়িত ছিল।
দালাল শাহীন বেপারির ছেলে দাদন বেপারি বলেন, ‘নাসির কাজী, তার দুই মামা আলিউজ্জামান ও আখতারুজ্জামান এবং ডিসি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে আমার আব্বাকে জিম্মি করে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়েছে। উত্তোলনকৃত এক কোটি ৮৮ লাখ টাকার মধ্যে ওরা আমার আব্বাকে ২০ লাখ টাকা দিয়েছিল। বাকি টাকা ওরা নিয়ে গেছে।
‘এই জালিয়াতি তদন্তকালে পুলিশ আব্বাকে ডিসি অফিসে যেতে বলে। আব্বা সেখানে গেলে তাকে কারাগারে নেয়া হয়। অথচ যারা টাকা নিয়ে গেল তাদের আজও ধরতে পারেনি পুলিশ। আব্বা বলেছেন, নাসির কাজী তাদের সামনেই কয়েক দিনে প্রায় ৮৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়াও আরও কত টাকা নিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই।’
বিপুল সম্পদ
একাধিক সূত্রে জানা যায়, শিবচরের দত্তপাড়া ইউনিয়নের বাচামারা গ্রামের মোজাজ্জেল হকের ছেলে কেএম নাসির (নাসির কাজী) এক সময়ে ছিলেন গ্রাম্য পশু চিকিৎসক। অভাব-অনটন সংসারে লেগেই থাকতো। পাশের উপজেলায় শ্বশুর বাড়িতেও বেড়াতে যেতেন না টাকার অভাবে।
সেই নাসির মাত্র চার/পাঁচ বছরে ব্যাপক বিত্তের মালিক হয়েছেন। গ্রামের বাড়িতে আলিশান ভবন, ঢাকার গুলশান ও উত্তরায় ফ্ল্যাট। কক্সবাজারে নির্মাণ করছেন বহুতলবিশিষ্ট হোটেল ভবন।
নাসিরের সাবেক স্ত্রীর স্বজন এবং দালাল সহযোগীদের কাছ থেকে এমন আরও অনেক তথ্য মিলেছে।
তারা বলেন, নাসির কাজীর বাসার দেয়াল ঘড়ির দামও দেড় লাখ টাকা। বাসার ফার্নিচার দুবাই থেকে আমদানি করা। রয়েছে একাধিক গাড়ি। নতুন সংসারে সন্তান হওয়ার পর দেন স্বর্ণের বাটি ও স্বর্ণের চামচ। তার ও স্ত্রীর মোবাইল ফোন সেটের ব্যাক কাভারও স্বর্ণের। সবমিলিয়ে এলাহী কাণ্ড কারখানা।
গ্রেপ্তারকৃত ইউপি সদস্য সুধাংশ মণ্ডল বলেন, ‘রেল লাইনের ভূমি অধিগ্রহণের সময় ডিসি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে নাসির শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে।
‘এক্ষেত্রে ডিসি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা নাসিরের বড় সহযোগী। তারাই ফাঁক-ফোকর বুঝিয়ে দিয়েছে। আমার মতো অনেকের সরলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে নাসির কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ আমরা আজ ফেঁসে গেছি। নাসিরকে ধরতে পারলে আমরাও রেহাই পাব।’
আরেক সহযোগী মুকুলী রানী বলেন, ‘নাসির আমাকে বলে- আপনাকে বাড়ি গাড়ি সব ব্যবস্থা করে দেব। প্রথমবার সে আমাকে দিয়ে ৬৩ লাখ টাকা উঠায়। তা থেকে আমাকে দেয় ৩ লাখ টাকা। পুনরায় কয়েক লাখ টাকা উঠিয়ে দেয় এক লাখ টাকা। এভাবে নাসির ও ডিসি অফিসের লোক মিলে শত শত মানুষের বিল উঠিয়ে আমাদের মতো গরিব মানুষগুলারে বিপদে ফেলেছে। ওকে ধরলে সব বের হয়ে আসবে।’
নাসির কাজীর প্রাক্তন স্ত্রীর বড় বোন বলেন, ‘শুনছি ও জিরো থেকে হিরো হয়ে গেছে। ওর এই অপকর্মে ডিসি অফিসের লোক ছাড়াও ওর মামা ও ভাইয়েরা জড়িত। জালিয়াতির কাজে ব্যবহারের জন্য নাসির আমাদের আইডি কার্ডও চেয়েছিল। আমরা দেইনি।’
নাসির কাজীর বাড়িতে গিয়ে তার মোবাইল নম্বর চাইলেও কেউ দিতে পারেনি। তার ভাই মতিউর কাজী মোবাইল ফোনে বলেন, ‘তার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নাই। আমার জানামতে সে ঢাকা বা ভারতে আছে।’
নাসিরের মামা মো আলীউজ্জামান প্রতারণার এক মামলার আসাামি। তিনি বলেন, ‘মামলাটি আমাদের সঙ্গে শত্রুতাবশত দেয়া হয়েছে।’
নাসিরে এতো সম্পদের মালিক কিভাবে হলেন বা কী ব্যবসা করেন- এমন প্রশ্নে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
প্রশাসনিক কর্মকর্তার যা বলছেন
মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ঝোটন চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় ২ জন স্টাফকে ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তা ও তহশিলদারের বিরুদ্ধেও তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আর দালালদের তালিকা দূদকে দেয়া হয়েছে।’
মাদারীপুর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক বলেন, ‘দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় সোচ্চার। ইতোমধ্যে কিছু দালালের তালিকা করা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘নাসির কাজীসহ সংশ্লিষ্টরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের অধিকার হরণ করেছে। আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত করছি। জড়িতরা যত ক্ষমতাশালীই হোক ছাড় দেয়া হবে না। আইন প্রয়োগকারী সব সংস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের মূল উৎপাটন করা হবে। আইনের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও তাদেরকে বয়কট করা হবে।