তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখনই বেশি জরুরি

Monday, September 4th, 2023

রিন্টু আনোয়ার
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের আন্দোলন খুব জোরালো করতে পারছে না বিরোধী দল। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার বলতে তারা বোঝে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা বলছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। এ যুক্তিতে এক দফা দাবিতে বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। জনমত তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তত্ত্বাবধায়ক আবার ফেরাবে সরকার? আবার ফিরিয়ে আনার জন্য কি বিধানটি বাতিল করেছিল তারা?

ঠাণ্ডা মাথার বুদ্ধিতে আদালতের মাধ্যমে কাফন পরিয়ে অসম্পূর্ণ দাফনে রাখা একটি পদ্ধতি আবার পুনরুজ্জীবন দেয়া সম্ভব নয় তা বুঝেই আইনমন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সুযোগ নেই। সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। সে অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। ওই রায়ের মধ্যেও ছিল কিছু প্রশ্ন বা প্যাঁচ। আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছিল, সংসদ চাইলে দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এর মধ্যেও গোলমাল। যা অবৈধ-অসাংবিধানিক তা কেন সংসদ চাইলে আরো দুইবার করা যাবে? আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংসদের কোন দায় আছে সেটি চাওয়ার?

তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের বুদ্ধি ব্যবস্থা বা অজুহাত বিএনপিই সরকারকে করে দিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি সরকার যদি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বয়স না বাড়াত তাহলে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিতর্কের মুখে পড়ত? আজকের ক্ষমতাসীনরাও তেমন কিছুর অপেক্ষা করছিল। বিতর্কের অজুহাত তোলা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের জন্য। বিতর্কিত অর্থ এই নয় যে, মাথাব্যথা থাকলে মাথা কেটে ফেলতে হবে। যেসব বিষয় নিয়ে সমস্যা ছিল সেগুলোর সংশোধন করা যেত। সরকার সেই পথে যায়নি। অজুহাতকেই ষোলআনা কাজে লাগিয়েছে।

দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সংবিধান বা আইনের তত্ত্বকথা বোঝেন না বা এত বোঝার কাজে যান না। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বেলায়ও একই বাস্তবতা। দলের শীর্ষপর্যায়ের কথা বাজারজাত করা তাদের কাজ। সুযোগটি কাজে লাগান চতুর রাজনীতিকরা।যেকোনো দেশের সংবিধান সে দেশ এবং জনগণের স্বার্থে প্রণীত এবং এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন ওই দেশ ও জনগণের স্বার্থে হওয়া উচিত- এ সত্যটি মেনে নিলে কিন্তু আর সমস্যা থাকে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রশ্নে আপিল বিভাগের ২০১১ সালের ১০ মে প্রদত্ত আদেশ এবং ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর নবম জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস ও ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ প্রকাশিত আপিল বিভাগের বিস্তারিত রায় আমলে নেয়ার মতো এত সময় কার? দরকারই বা কী?

সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে স্বাধীনতার পর যদি বাংলাদেশে ভালো একটি কাজও হয়ে থাকে সেটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। কিন্তু, আইনটিকে ‘ইমিউনিটি’ দেয়া হয়নি। আরো অন্যান্য আইনের মতো যেনতেন আইন রাখা হয়েছে। কেউ বা কোনো সরকার চাইলেও এ আইন পরিবর্তন বা বাতিল করতে পারবে না- এমন ইমিউনিটি দেয়া হলে তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে এত নোংরামি কেউ করতে পারত না।

প্রায় তিন দশক আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নির্বাচন পদ্ধতি। কার অধীনে নির্বাচন হবে- ক্ষমতাসীন সরকার, নাকি নির্দলীয় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার? সেই বিতর্কের অবসান হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যখন ক্ষমতাসীন বিএনপি প্রবল বিক্ষোভের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে এ নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। এখন এ বিতর্ক নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিদার। কিন্তু ২০২৩ সালে বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু ১৯৯৬-এর পরবর্তী ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০১-০৬ সালে বিএনপি সরকারের একটি সিদ্ধান্ত এমন একটি প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়, যেটি সম্ভবত গোটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বিতর্কের মুখে ফেলে দিয়েছে।

নব্বই সালে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের পতনের পর চারটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে একবার বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষমতায় পালাবদল হয়। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোনো একটি দল পরপর দুইবার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। পরাজিত দল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও এসব নির্বাচনের ফল দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।

১৯৯১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও সে ধরনের সরকারব্যবস্থা সংবিধানের অংশ ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সে নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সাল থেকে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলে ধরে একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকার সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে, যেটি সব বিরোধী দল শুধু বর্জন নয়, তীব্র বিক্ষোভের মাধ্যমে প্রতিহতের চেষ্টা করে। বিতর্কিত ওই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর প্রবল আন্দোলনে ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ তৎকালীন বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়।

এর পর ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। দেশে-বিদেশে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। নির্বাচনে পরাজিত দল বিএনপি নির্বাচনে ‘পুকুর চুরি’র অভিযোগ আনলেও তাদের সেই দাবি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে। সে নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোট ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে পক্ষপাতিত্ব ও কারচুপির অভিযোগ আনে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেটি হালে পানি পায়নি, ২০০১ সালের সে নির্বাচনও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।

নানা দিক ভেবেচিন্তে ক্ষমতাসীনরা খুব বুদ্ধি করে বিষয়টি আদালতের ঘাড়ে নিয়ে কাফন পরিয়েছে। বিচারপতি খায়রুল হক চূড়ান্ত রায় থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন। অবসরের পরপর জাতীয় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়াসহ এর নানা পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। রায়ে কিঞ্চিত গোলমালও রেখে গিয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার সুযোগ থাকার পরও, সে পথে না গিয়ে আদালতের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করেছে। বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় বিএনপির খোঁচা দেয়া জায়গায় ফোঁড়া বানিয়ে আওয়ামী লীগ বেনিফিট নিয়েছে।

আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে। অর্থাৎ এটি হলো অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধন। এটি অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধনী হওয়ার আরো কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন- সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর সুবাদে গণভোট অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক হলেও পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের সময় তা করা হয়নি। কারো কারো মতে, সংসদ ইচ্ছা করলে এরই মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে। সরকার বা সরকারি দল কোন দুঃখে আত্মহননের কাজটি করবে? তার চেয়েও বড় কথা মূল রায় আর সংক্ষিপ্ত রায়ে একটি কেওয়াস বাধিয়ে দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক হলে পরবর্তী দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলে তা বৈধ হয় কিভাবে? এ স্ববিরোধিতাও কারো কারো কাছে শুধু প্রশ্ন নয়, হাতিয়ারও। চিকন বুদ্ধিতে তারা বলতে চান, রায়ে বলা হয়েছে ‘সংসদ চাইলে’। সংসদ তো চায়নি। অতএব তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল একদম শুদ্ধ। মানুষ এ মশকরার শিকার হতে বাধ্য।

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত আদেশটি নিয়ে সরকার-বিশিষ্টজন ও গবেষকদের অবস্থান তখন থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সরকার ও বিশিষ্টজনদের মতে, আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-সম্পর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী একতরফাভাবে পাস করা হয়। বিপরীতে, গবেষকদের মতে, আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়।

বিপরীতমুখী এ অবস্থানের পেছনে যুক্তি হলো, সংসদের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিষয়টি আদালতের পর্যবেক্ষণ, আদেশ নয়। উপরিউক্ত আদেশ থেকে সুস্পষ্ট যে, আদালত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সংসদের সম্মতির শর্ত দেননি; বরং আদালত সংক্ষিপ্ত আদেশে ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা এবং জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সম্মতি দিয়েছেন। অর্থাৎ আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যস্থা বাতিল করা হয়।

ক্ষমতাসীন দল এবং তার সমর্র্থকদের এখন আর এসব যুক্তির ধারেকাছে যাওয়ারও সময় নেই। এক সংসদকে দিয়ে ভবিষ্যৎ সংসদের হাত-পা বেঁধে দেয়ার কাজটিও তারা সেরে নিয়েছেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com